নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ,
ছোট-বড় প্রায় তিন শতাধিক নদী আছে আমাদের দেশে যার মাঝে পদ্মা, মেঘনা,
যমুনা, কুশিয়ারা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য আর
উপনদী, শাখানদীসহ মোট নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার। আবহমানকাল হতে
এই সব নদ-নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে প্রতিটি শহর, বন্দর,
গঞ্জ, বাজার প্রভৃতি । এই বৃহৎ জলভূমির
জন্য পূর্ব পুরুষ থেকে আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালী নামে পরিচিত । মাঝ নদীতে
এ দেশের সাহসী জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে মাছ আহরণ করে। এশিয়ার
সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা
নদী ও আমাদের দেশে অবস্থিত । এই মৎস্য সম্পদদের প্রাচুর্যের জন্য গড়ে উঠেছে
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সিটিউট, মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র , নদী গবেষণা কেন্দ্র, অসংখ্য মৎস্য খামার ও মৎস্য হ্যাচারি যা আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রেখেছে । খাদ্য হিসেবে মাংসের চেয়ে মাছ অনেক বেশি উপকারী এবং
তুলনামূলক সাশ্রয়ী । আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাছ একটি অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীজ আমিষ উপাদান।
অন্যান্য প্রাণীজ আমিষের চেয়ে মাছ অনেক বেশি পুষ্টিকর একটি খাদ্য । মাছে অল্প
পরিমাণে ফ্যাট এবং পর্যাপ্ত
পরিমানে প্রোটিন, ওমেগা ৩ ফ্যাটি
অ্যাসিড , ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি , ভিটামিন সি ,
ভিটামিন
বি -১২, ভিটামিন বি- ৬ , ম্যাগনেসিয়াম ,আয়রন,
ক্যালসিয়াম
ইত্যাদি পাওয়া যায় । আমাদের দেশে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের গড় ২৫০০ ক্যালরি শক্তি
প্রয়োজন । আমার জানি অন্যান্য খাবারের তুলনায় আমিষজাতীয় খাবার হতে বেশি পরিমাণে
ক্যালরি (প্রায় ৪.৩৫ কিলোক্যালরি/গ্রাম) পাওয়া যায় । দেহ গঠন , দেহের ক্ষয় পূরণ,শক্তি সাধন, দেহ কোষের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য আমিষের প্রয়োজন । এই
আমিষের অভাব দূরীকরণে মাছ হতে পারে মাংসের পরিপূরক । আমরা জানি বাংলাদেশে পৃথিবীর ৮ম
জনবহুল দেশ। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত আদমশুমারীর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার ; জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইল
এলাকায় ২৪৯৭ জনের বেশী । এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে ৭০ শতাংশের ও বেশি নিন্মবিত্ত
যাদের পক্ষে ২০০/৩০০ টাকা খরচ করে মাংস খাবার সামর্থ্য নেই । মানুষের খাদ্যের
চাহিদা দিন দিন যে হারে বাড়ছে তাতে করে
আমিষের ঘাটতি পূরণে মৎস্য উৎপাদন বাড়ানো ব্যতিত অন্য কোন সহজ, সুলভ বিকল্প নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপট
বিশ্লেষণে মাছ কে সহজলভ্য এবং মানুষের হাতের নাগালের কাছে আনতে মৎস্য চাষ ব্যাপক
হারে বাড়াতে হবে। তাদের কথা মাথায় রেখে মাছের গুনগত মান বাড়ানো এখন সময়ের দাবি ।
বাংলাদেশে ফ্রেসওয়াটার বা স্বাদুপানির ২৭০ এর অধিক প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। আমাদের
দেশে দেশী মাছের মাঝে সুপরিচিত ইলিশ , কাচকি , কালিবাউস, পাবদা , টেংরা, কাতলা ,কৈ
, বোয়াল , রুই , মলা , বাইম , মাগুর , শিং , চাপিলা , শরপুঁটি , টাকি , চিতল ইত্যাদি মাছ সচরাচর পাওয়া যায় । তবে অধিক আহরণ , বিপুল
চাহিদার, প্রজনন সময়ে মা মাছ নিধন, অবাধ জাটকা, পোনা মাছ নিধন অপরিকল্পিত
ভাবে মাছ চাষ, প্রজনন ক্ষেত্রবিনাশ
ইত্যাদি নানা সমস্যার প্রেক্ষিতে এই অনেক মৎস্য প্রজাতির
সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে তার মাঝে তিত পুঁটি ,তারা বাইম ,সাদা ঘনিয়া, রাঙ্গা
চান্দা,ফোপা চান্দা,নুনা টেংরা,নাপটি কই,লাল খোলিশা, কানি টেংরা,বামুশ ইত্যাদিসহ অনেক
দেশী মাছ এখন আর আগের মত দেখা যায় না । এইসব মৎস্য প্রজাতি আশঙ্কা জনক ভাবে হ্রাস
পাওয়া আমাদের মৎস্যক্ষেত্রের অগ্রগতি জন্য বিশাল বাধা স্বরূপ । এইসব মৎস্য প্রজাতি রক্ষার জন্য এখনি পদক্ষেপ
নেয়া জরুরী। পাশাপাশি এই মৎস্য সম্পদের সম্ভাবনার বিষয় মাথায় রেখে মাছের
উৎপাদন এবং গুণগত মান বাড়ানোর জন্য বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশী ও হাইব্রিড মাছ
চাষের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে । তেলাপিয়া, স্কেল কার্প, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, থাই সরপুঁটি , মিরর
কার্প, বিগহেড কার্প, ব্ল্যাক কার্প,
আফ্রিকান মাগুর, থাই পাঙ্গাস , নাইলোটিকা , মিনার কার্প , মনোসেক্স
তেলাপিয়া, মনোসেক্স স্কেল কার্প, রেড
তেলাপিয়া, মিল্ক ফিস, গোল্ড ফিস ,গুরামি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশী মাছ এপর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছে । বিপুল
পরিমাণে মাছের চাহিদা, অধিক পরিমাণ মৎস্য
আহরণ ইত্যাদি নানা কারনে বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশী এবং হাইব্রিড মাছের
গুরুত্ব বাড়ছে । হাইব্রিড বলতে মূলত দুটি ভিন্ন প্রজাতির মাঝে ক্রস করে নতুন জাতের
সৃষ্ট প্রাণীকে হাইব্রিড বলে এবং এই পুরো প্রক্রিয়া কে হাইব্রিডাইজেসন বলে ।
হাইব্রিডাইজেসন প্রাকৃতিক ভাবে হতে পারে আবার মানব সৃষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে ও হতে
পারে । কম সময়ে দ্রুত বর্ধনশীল, অধিক রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন, গুণগত মান
সম্পন্ন হাইব্রিড মাছের গুরুত্ব অনেক।
হাইব্রিডাইজেসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নতমানের বীজ,
পোনা
পাওয়া যায়। ঢাকা শহর এবং এর আশেপাশে যেমন
কাওরান বাজার, গাজীপুর চৌরাস্তা
মাছের বাজার , কালিয়াকুর, টঙ্গি ইত্যাদি
মাছের বাজারে ব্যাপক হারে হাইব্রিড কার্প , রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, থাই কই , সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প, দেখা যায় যা উন্নতমানের বিদেশী ও হাইব্রিড মাছের পোনা, বীজ এর ফসল । এই সব উন্নতমানের পোনা, বীজ
এর বেশীর ভাগই আসে মির্জাপুর ,
ত্রিশাল
, গৌরীপুর , কালিয়াকুর হতে । হাইব্রিড ও বিদেশী মাছের
চাহিদাকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক বছরে কয়েক
শতাধিক মাছের হ্যাচারি এবং মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে ঢাকার আশেপাশে ।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৯৩৬ টি মৎস্য হ্যাচারী রয়েছে । বাংলাদেশে বর্তমানে মৎস্যচাষি
রয়েছে ১৩৮.৬৪ লক্ষ, বার্ষিক মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৩৪,১০,২৫৪ মেট্রিক টন
যার মাঝে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরিত হয়
প্রায় ৯,৬১,৪৫৮ মেট্রিক টন এবং চাষকৃত হয় প্রায় ১৮,৫৯,৮০৮ মেট্রিক টন, সমুদ্র
থেকে আহরিত হয় প্রায় ৫,৮৮,৯৮৮ মেট্রিক টন । এখানে লক্ষণীয় যে বিপুল পরিমাণে মাছের উৎপাদন হচ্ছে তার
সিংহভাগ আসে চাষকৃত মৎস্য খামার হতে যা বার্ষিক মৎস্য উৎপাদন এর অর্ধেক এর চেয়েও
বেশি । এরমাঝে কিছু প্রজাতির মাছের চাষ যেমন কার্প জাতীয় , তেলাপিয়া বিশেষ করে মনোসেক্স তেলাপিয়া,হাইব্রিড কার্প জাতীয় মাছের খামারের সংখ্যা
উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে । বর্তমান বিশ্বে মনোসেক্স বা একজাতীয় মাছ উৎপাদনের হার
দিন দিন বাড়ছে। ইহা মূলত দ্রুত বর্ধনশীলতা উপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয় যেমন তেলাপিয়া মাছের
ক্ষেত্রে পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছের চেয়ে খুব কম সময়ে দ্রুত বাড়ে । শুধু তাই নয় স্ত্রী মাছ খুব কম সময়ের ব্যবধানে আবার ডিম ছাড়ে তার ফলে পুকুরে মাছের সংখ্যা
অনেক বেড়ে যায় কিন্তু মাছের দৈর্ঘ্য বাড়ে না। পুকুরে অতিরিক্ত মাছের জন্য অন্য
মাছের ও খাদ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় যা বাণিজ্যিক মৎস্য চাষের জন্য সহায়ক নয়। এইসব
সমস্যাগুলো পর্যালোচনা করে আমাদের দেশে মনোসেক্স বা একজাতীয় মাছ উৎপাদনের হার দিন
দিন বাড়ছে ; বিশেষ করে
মনোসেক্স বা তেলাপিয়ার চাষ বাংলাদেশে বিগত
কয়েক বছরে বিপুল হারে বেড়েছে । তাই এই মৎস্য সেক্টরকে আরও গতিশীল এবং লাভজনক করার জন্য আমাদের উচিৎ
মৎস্যচাষিদের আর ও বেশি উৎসাহ প্রদান করা তার পাশাপাশি মৎস্যবিষয়ক জনসচেতনতা
বাড়ানো । তবে এক্ষেত্রে শুধু মৎস্য উৎপাদন বাড়ালে হবে না তার পাশাপাশি মাছের
পুষ্টিমান , স্বাদ ও বাড়াতে
হবে । হাইব্রিড মাছ চাষের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম মানতে হবে। মাছের মাঝে ক্রস করানোর ক্ষেত্রে পিতামাতার মূল উৎস বা
প্যারেন্টাল অরিজিন এর রেকর্ড রাখতে হবে এবং নির্ভুল পরিকল্পনার ছক তৈরি করতে হবে । পর্যাপ্ত পরিমাণ
সতর্ক থাকতে হবে এবং সঠিক ভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে যাতে করে আসল প্রজাতির মাছ
যাতে করে হারিয়ে না যায় । প্রজাতির
বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে মৎস্য খামারের চাষিদের কে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে । থাই
পাঙ্গাস , আফ্রিকান মাগুর, থাই পুঁটি , তেলাপিয়া ইত্যাদি উচচপ্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন এবং রাক্ষুসে
স্বভাবের মাছ চাষের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমান জনসচেতনতা সৃষ্টি
করতে হবে । আমাদের দেশে উন্মুক্ত জলাশয়ের
পরিমান প্রায় ৩৯,১৬,৮২৮ হেক্টর আর চাষকৃত জলাশয়ের
পরিমান ৭,৮২,৫৫৯ হেক্টর। এই বিপুল পরিমান
জলাশয়ের বেশির ভাগ যেমন বাড়ির আশেপাশে , অব্যবহত পুকুর, ডোবা ,
নালা, বিল ইত্যাদিতে বিদেশী ও হাইব্রিড মাছ চাষ
করে নিজেদের আমিষের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি একটি ভালো আয়ের উৎস তৈরি করা সম্ভব যা
দিয়ে মানুষের অনন্যাও চাহিদা যেমন অন্ন,
বস্ত্র
, বাসস্থান ভালভাবে পূরণ
করা সম্ভব । মৎস্য উৎপাদনের এই ক্ষেত্রকে
আর বেগবান, শক্তিশালী করতে
সরকারের পাশাপাশি মৎস্য ব্যবসায়ী ,
মৎস্য
কর্মকর্তা , এবং মৎস্য
ক্ষেত্রের সাথে জড়িত সকল পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে সর্বোপরি সকল সাধারণ জনগনকে জনমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে । তাই সকলের
স্লোগান হোক “অন্ন, বস্ত্র , বাসস্থান মাছ চাষে সমাধান ” ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Download NTRCA Viva Exam Admit card
Download link : http://ntrca.teletalk.com.bd/admitcard/ 13th NTRCA Viva Exam Admit card
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhjT_sR7Y0knBJ3ERCOu221pVUUGtblGBRXkS4pc8FEPBByvjsGbjrkpuxtQhvq8HIR2Jk5yroVZzhXxWHh2zj7lnIZr7ne6Ctz0f5cuFhitj_XCN29oNs6WmVZycYdxijQksrGMiLh_zA0/s320/ntrca-result-logo.jpg)
-
1) She likes to fantasize about winning the red crescent lottery. 2) The minister arrived at a decision last night. 3) Can you put m...
-
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাছ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীজ আমিষ উপাদান । মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এর অবস্থান চতুর্থ । বর্তমান...
No comments:
Post a Comment